স্বপ্ন সারথীর বিদায়

স্বপ্ন সারথীর বিদায়

আনিসুল হক

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের নিশ্চিতে ঘুমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র নির্বাচিত হওয়া আনিসুল হক এখন চিরনিদ্রায় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ঢাকা উত্তরের নগরপিতা সপরিবারে যুক্তরাজ্যে গিয়ে গতকাল সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে।

সফল উদ্যোক্তা থেকে ক্ষণজন্মা এই মেয়র মাত্র দেড় বছরেই প্রতিশ্রুতির অনেকটাই পূরণ করেছেন, জায়গা করে নিয়েছেন নগরবাসীর অন্তরে। মেয়র হওয়ার আগে বলিষ্ঠ কণ্ঠের টিভি উপস্থাপক থেকে তিলে তিলে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের নিশ্চিতে ঘুমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র নির্বাচিত হওয়া আনিসুল হক এখন চিরনিদ্রায় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ঢাকা উত্তরের নগরপিতা সপরিবারে যুক্তরাজ্যে গিয়ে গতকাল সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে।

সফল উদ্যোক্তা থেকে ক্ষণজন্মা এই মেয়র মাত্র দেড় বছরেই প্রতিশ্রুতির অনেকটাই পূরণ করেছেন, জায়গা করে নিয়েছেন নগরবাসীর অন্তরে। মেয়র হওয়ার আগে বলিষ্ঠ কণ্ঠের টিভি উপস্থাপক থেকে তিলে তিলে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে।

লন্ডনের সময় ৪টা ২৩ মিনিটে মৃত্যুবরণ করা আনিসুল হকের কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র (ভেনটিলেশন যন্ত্র) বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাতে খুলে নেন চিকিৎসকরা। এরপর তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ১৯৫২ সালে জন্ম নেওয়া আনিসুল হকের বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেলেন।

আনিসুল হকের পারিবারিক ওই সূত্র জানায়, হাসপাতালে চিকিৎসারত আনিসুল হকের জীবনের শেষ মুহূর্তে তাঁর পাশে উপস্থিত ছিলেন স্ত্রী, পুত্র ও কন্যারা। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে আগামীকাল শনিবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে আনিসুল হকের মরদেহ ঢাকায় পৌঁছবে বলে জানিয়েছে ডিএনসিসি। বিমানবন্দর থেকে মরদেহ তাঁর বাসায় নেওয়া হবে।

ওই দিন বাদ আসর আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে মরহুমার লাশ রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। আজ শুক্রবার লন্ডনের রিজেন্ট পার্ক জামে মসজিদে জুমার নামাজের পর আনিসুল হকের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।

গত ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে যান মেয়র আনিসুল হক। সেখানে থাকাবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৩ আগস্ট তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা তাঁর শরীরে মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ ‘সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিস’ শনাক্ত করেন। তখন তাঁকে লন্ডনের একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। অবস্থার উন্নতি ঘটার পর গত ৩১ অক্টোবর তাঁকে আইসিইউ থেকে রিহ্যাবিলিটেশনে স্থানান্তরের খবর জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল ডিএনসিসি। আনিসুল হককে নিয়ে নানা গুঞ্জনের প্রেক্ষাপটে গত ২৩ নভেম্বর ডিএনসিসি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় যে, তাঁর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। পরে অবস্থার অবনতি হলে গত মঙ্গলবার তাঁকে আবারও আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। ওই সময় আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক সাংবাদিকদের জানান, সংক্রমণের কারণে আনিসুল হককে আবার আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে।

আনিসুল হকের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর, নোয়াখালীতে। শৈশবের বেশ কিছু সময় কেটেছে ফেনীর সোনাপুর গ্রামে, নানাবাড়িতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়  ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা আনিসুল হক খ্যাতি অর্জন করেন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিটিভিতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুখোমুখি একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। ১৯৮৬ সাল থেকে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উত্তাল দিনগুলোতে। এ ছাড়া, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ, সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্টস পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে।

সরাসরি কোোনা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকা আনিসুল হক ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি থাকাকালে ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা নেন। সেনাসমর্থিত ওই সরকারের শুরুতেই রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হতে থাকে। তখন বাজারে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়ে যায়। তখন ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় ‘বেটার বিজনেস ফোরাম’ গঠনে মূল ভূমিকা পালন করেন আনিসুল হক। তখন অর্থপাচার রোধে ৫০০ টাকার নোট বাতিল করার প্রস্তাবও করেছিলেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পরস্পরের কাছাকাছি আনতে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান আয়োজনে মূল ভূমিকা পালন করেন আনিসুল হক।

২০১৫ সালের মেয়র নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন। মেয়র হয়ে তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনার এক ফুঁয়ে আমি নেতা। মন্ত্রী মর্যাদার মেয়র হয়েও নেতাসুলভ ভাব ছিল না আনিসুলের মধ্যে। আওয়ামী লীগের ব্যানারে রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সফল ব্যবসায়ী আনিসুল হকের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে দল-মতের ঊর্ধ্বে রেখেছেন নিজেকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে রেখে বিরোধীদের সমালোচনা থেকে বিরত থেকেছেন, দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মতিতে নগরের উন্নয়নে নির্বাচনী ইশতিহার বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুক্তরাজ্য সফরে যাওয়ার অল্প কয়েক দিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে আনিসুল হক বলেছিলেন, মেয়র হিসেবে তিনি এমন কিছু করতে চান, যাতে তাঁর মৃত্যুর পরও নগরবাসী তাঁকে মনে রাখে। ওই কথা বলার পর নগরবাসীর উন্নয়নে বিশেষ কিছু করার সময় পাননি আনিসুল হক। তবে উত্তরের বাসিন্দারা মনে করছে, মাত্র দেড় বছরে মেয়র হিসেবে আনিসুল হক যে সফলতা দেখিয়েছেন, তাতে নগরবাসীর মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।

২০১৫ সালের ৬ মে ডিএনসিসির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় এক কোটি মানুষের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। সেই থেকে নিরন্তর নগরবাসীর স্বপ্ন পূরণে ছুটেছেন তিনি। মেয়াদের অর্ধেক পেরোনোর আগেই সফলতা দেখিয়েছেন, প্রশংসাও কুড়িয়েছেন অনেক। মেয়র হওয়ার আগেই ‘আমরা ঢাকা’ নামে স্লোগান তুলে আনিসুল হক নগরবাসীকে উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। কোথাও কোনো সেবার প্রয়োজন হলে ছবি তুলে মেয়রকে জানানো যেত। দু-এক দিনের মধ্যেই প্রতিকার মিলত। ঢাকার রাস্তায় অভিজাত যাত্রী ছাউনি নির্মাণ, রাস্তা থেকে ময়লা অপসারণ, চলাচলের উপযোগী ফুটপাত নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কারসহ নানা কর্মকাণ্ডে মাত্র দেড় বছরেই বড় সফলতা অর্জন করেছেন আনিসুল হক।

যানজট কমাতে কঠোর ভূমিকা পালন করেন, মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১২, তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল, কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন রাস্তা, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, গাবতলী, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের সুব্যবস্থা করেছেন। নগরের যানজট কমাতে ইউলুপ নির্মাণের কাজও শুরু করেন। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম এক বছরের মধ্যেই ১১৮ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছেন, ৪৫১টি রাস্তা উন্নয়নের কাজ করেছেন, ১৪৮ কিলোমিটার ড্রেনে সংস্কার এনেছেন। ৬৮ কিলোমিটার ফুটপাতের উন্নয়নও করেছেন প্রথম এক বছরেই।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু ডিএনসিসিতে এ ধরনের দুর্নীতি রোধ করতে পেরেছিলেন আনিসুল হক। মেয়াদের এক বছর পূর্তিতে কালের কণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা প্রথম দিন থেকেই স্বচ্ছতার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি দিয়েছি। আমি সবাইকে বলেছি, আমরা হয়তো শতভাগ স্বচ্ছ হতে পারব না, তবে যতটুকু সম্ভব তা নিশ্চিত করে যাচ্ছি। প্রথম থেকেই ই-টেন্ডারিং করা শুরু করেছি। এ নিয়ে অনেকেই বাধা-বিপত্তি তৈরি করার চেষ্টা করেছে। আমি ইতিমধ্যে দাপ্তরিকভাবে ফাইল তিন দিনের বেশি না রাখার নির্দেশ দিয়েছি। এ ছাড়া, মাসে ২০ লাখ টাকার জ্বালানি ব্যয় কমিয়ে এনেছি। ’

বর্তমান সেনাপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকের ভাই আনিসুল হক নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিতেন অকপটে। ২০১০ সালে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির মেয়াদ শেষে কালের কণ্ঠকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সভাপতি নির্বাচনের আগে এফবিসিসিআইতে তিনি শক্তিশালী গবেষণা সেল প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু দুবছর মেয়াদ শেষ হলেও আমি তা করতে পারিনি। এটি আমার ব্যর্থতা। ঢাকার জলাবদ্ধতায় নগরবাসীর দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে একাত্মতা স্বীকার করে আনিসুল হক বলেছিলেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষে জলাবদ্ধতা দূর করা দুরূহ। তবে ঢাকা উত্তরকে ‘স্মার্ট সিটি’ হিসেবে গড়ে তোলা, যানজট কমানো, আবর্জনামুক্ত ঢাকা গড়া, পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা এমনকি প্রভাবশালী দেশগুলোর দূতাবাসের দখল থেকে গুলশানের ফুটপাত নগরবাসীর হাঁটার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস টব বসানোসহ নানাভাবে ফুটপাত দখল করে নগরবাসীকে সেখান দিয়ে হাঁটতে বাধা দিয়ে আসছিল। মেয়র আনিসুল হক বলিষ্ঠভাবে ওই সব ফুটপাতের দখল নিয়ে নগরবাসীর জন্য তা উন্মুক্ত করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার দেশের ফুটপাত দিয়ে আমার নাগরিকরা হাঁটতে পারবে না, এটা হতে পারে না। ’

মেয়রের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও বিরোধীদলীয় নেতার শোক : মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও শোক প্রকাশ করেন। তাঁরা আনিসুল হকের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবার, আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ী ও সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

 

Source: Kalerkantho Link to the Original Article